প্রথম সারি Good Luck

লিখেছেন লিখেছেন মামুন ৩০ আগস্ট, ২০১৪, ০৭:৪৫:৩৩ সকাল



Rose

এই এলাকাটা এক সময় বলতে গেলে বিরান ভূমিই ছিল। মাইলের পর মাইল খোলা মাঠ। উচু-নীচু এবড়ো থেবড়ো শক্ত মাটি। অনেক শক্ত। আর ছিল নদী-খাল আর জলাশয়।যেগুলি লাখ লাখ মশার প্রজনন কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহৃত হতো। পরবর্তীতে ইটের ভাটা বানানো শুরু হয়। ধীরে ধীরে এলাকাটা একটু জাতে উঠে আসে। গরীব লোকাল মানুষেরা একটু একটু করে সচ্ছল হতে থাকে। ছোট ছোট কিছু দোকান গড়ে উঠে। ইটের ভাটার শ্রমিক যারা বাইরে থেকে এসে এখানে কাজ করে, মূলত ওদের জন্যই এই দোকানগুলো তৈরী হয়েছিল। এরপর একেবারে ক্ষুদ্র কাঁচাবাজার... কসাইর দোকান... মাছ বাজার। আরো পরে একটা সাপ্তাহিক হাটই বসে গেলো। অবশ্য ততোদিনে বাহির থেকে অনেকে সস্তায় জমি পাওয়াতে যায়গা কিনে স্থায়ী বসত গড়ে তুলেছে। এরাই আজকের এই বিশাল গার্মেন্টস ফ্যাক্টরী সংলগ্ন যায়গাটিতে নেতৃত্ব দান করছে। কারণ তাঁদের ভিতর ছেলেমেয়েরাই শিক্ষাদীক্ষায় অগ্রগামী ছিল। আর একেবারে লোকালেরা শুধু জমি বিক্রি করেছে, নেশায় উড়িয়েছে। এখন অবশ্য এরা গার্মেন্ট শ্রমিকদেরকে ঘরভাড়া দিয়ে ভালোভাবেই আছে।

এলাকায় সমিতির নামে চলছে সরাসরি সুদের ব্যবসা। চড়া সুদ নিয়ে ব্যবসা করে যাওয়া এই সমিতিগুলোর সংখ্যাও কম নয়। বলতে গেলে প্রতিটি ঘরে ঘরেই নিদেন পক্ষে একজন করে হলেও এই ব্যবসার সাথে জড়িত।

সবাই মিলে বিশাল এক মসজিদ করেছে। খুব আধুনিক স্থাপত্যের নিদর্শন দেখা যায়। এক গার্মেন্ট মালিক মসজিদের দুটো তলারই রড একা দিয়েছেন। আর বাকি কাজ সবাই মিলে মিশে দান করে এবং চাঁদা তুলে করেছে। একটা দেখার মতই মসজিদ হয়েছে।

বদরুল মুন্সী একজন বহিরাগত কিন্তু বর্তমানে স্থানীয় হয়ে গেছেন। তার বাবা একেবারে প্রথমদিকে এই এলাকায় বহিরাগতদের যে প্রথম দলটি বসবাস করার জন্য আসে, তাঁদের অন্যতম ছিলেন। অনেক যায়গা কিনে নিয়েছিলেন। আর চার ছেলেকেই পড়ালেখা শিখিয়েছেন। সবাই-ই গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেছে। বদরুল মুন্সী এদের ভিতর সবার বড়। এখন সমাজসেবায় চাকরি করেন। এলাকায় একটা চার ইউনিটের পাঁচতলা বাড়ি করেছেন। মাস গেলে দেড় লাখের উপরে ভাড়া পান। এছাড়া নিজের কয়েকটা সমিতি রয়েছে। সেখান থেকেও সুদের ব্যবসার লাভ হিসাবেও অনেক টাকা আসে। তিনিই এই মসজিদ কমিটির সভাপতি!

মসজিদের ইমাম সাহেব খুব জ্ঞানী মানুষ। জুমার খুৎবার আলোচনায় সব কিছু নিয়ে বয়ান করলেও এলাকার প্রভাবশালীদের বিপক্ষে যায়, এমন কিছু নিয়ে কেন জানি বয়ান করেন না। এই বিষয়গুলোতে তার অ্যালার্জি রয়েছে বোধ হয়। তিন বেলা প্রতি ঘর থেকে তার কাছে খাবার চলে আসে। আর এসকল ঘরের উপার্জনক্ষম কেউ না কেউ সুদের ব্যবসার সাথে জড়িত!

এখন রমজান মাস।

তারাবিহ নামাজ শুরু হয় এশার জামাতের পরপরই। আব্দুল মোতালেব একজন রিক্সাচালক। এখানেই এক রুমের একটি ভাড়া বাসায় নিজের বউকে নিয়ে থাকে। সারাদিন রিক্সা চালায়। যা পায় তাতেই নিঃসন্তান এই দম্পতির দিন ভালোভাবেই চলে যায়। অনেক রিক্সাওয়ালাই রোজার দিনে রোজা রাখে না। শারীরিক কষ্টের দোহাই দিয়ে তারা এই ফরজ ইবাদতটি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। আর দুপুর বেলা রাস্তার পাশের পর্দা ঘেরা ইতালিয়ান হোটেলগুলোতে ঢুকে পেট ভরে ভাজাপোড়া খেয়ে নেয় দেদারছে। কেন জানি এই মাসে ওদের খিদেটাও বেশী লাগে। আর খাবার পরে বিড়ি ফুঁকে আশপাশটাকে গন্ধে ভরিয়ে দেয়।

সেদিক থেকে আব্দুল মোতালেব একদম অন্যরকম। সে কোনো নেশা করে না। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে। জামাতের সাথে করার চেষ্টা করে। যথাসম্ভব ধর্মীয় বিধানগুলো সে নিষ্ঠার সাথে পালন করে।

প্রথম তারাবিহ'র দিন। এশার নামাজ আদায় করতে এসেছে আব্দুল মোতালেব। গত জুমায় ইমাম সাহেবের বয়ান শুনে জেনেছে, জামাতের প্রথম কাতারে দাঁড়ানোর এতোটা সওয়াব যে মানুষ বুঝতে পারলে তা নিয়ে মারামারি লাগিয়ে দিতো। সে সব সময় দ্বিতীয় বা আরো পিছনের কাতারে নামাজ আদায় করে এসেছে। বেশীর ভাগই বারান্দায় দাঁড়িয়েছে। তবে প্রথম তারাবিহ'র দিন ওর প্রথম কাতারে দাঁড়ানোর বড্ড ইচ্ছে হয়। টাইলসের উপর দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে সে দেখতে পেলো সামনের সারির অধিকাংশ যায়গাতেই জায়নামাজ বিছিয়ে রাখা। কিছুই না বুঝে সে ইমামের ডান দিকের দুইজনের পরের স্থানটিতে জায়নামাজের উপর বসে গেলো। ওখানে বসে চোখ বুজে আল্লাহ আল্লাহ করতে থাকে। কতক্ষণ এভাবে ধ্যানমগ্ন ছিল বলতে পারবে না। হঠাৎ একজনের স্পর্শে সে চোখ মেলে তাকায়।

ততোক্ষণে মসজিদ প্রায় ভরে গেছে। প্রথম সারির জায়নামাজগুলোতে এলাকার সব প্রভাবশালীরা বসা রয়েছেন। বদরুল মুন্সীর শ্যালক আব্দুল মোতালেবকে পীঠে হাতের মৃদু স্পর্শ দিয়ে তার নিজের দিকে ফেরায়। বলে, ' এখানে বসলা যে, দেখো নাই জায়নামাজ বিছানো আছে?' আশেপাশের সকল মুছল্লিরা অবাক হয়ে আব্দুল মোতালেবের দিকে তাকিয়ে রয়। তাঁদের অনেকের চোখে সে ওর প্রতি ঘৃণা মেশানো দৃষ্টির আঁচ অনুভব করে। তারা যেন নীরবে একজন রিক্সাওয়ালার এতো বড় স্পর্ধায় ওকে ধিক্কার জানাচ্ছিল। আব্দুল মোতালেব একবার ঘাড় ফিরিয়ে ইমাম সাহেবের দিকে তাকায়। ওর সেই সরল চোখের ঠাণ্ডা আগুনকে সহ্য করতে না পেরে ইমাম সাহেবও চোখ নীচে নামিয়ে নেন।

আব্দুল মোতালেব মাথা উঁচু করে কিন্তু দৃষ্টি নত করে একেবারে শেষ কাতারে গিয়ে দাঁড়ায়। প্রথম কাতার তার মত মানুষের জন্য নয়! যদিও আল্লাহর নবীর শিক্ষা এরুপ ছিল না সে জানে। কিন্তু এই আল্লাহর ঘরটা বানানোর জন্য এখন যারা প্রথম সারিতে জায়নামাজ বিছিয়ে বসে আছে, সে তাদের মত টাকা-পয়সা দিতে পারে নাই। সমাজে তার মর্যাদা-ই বা কি? যে সমাজের নেতা নির্বাচিত হয় টাকার দ্বারা... মসজিদ কমিটির সভাপতি হয় সরকারি ঘুষখোর একজন সুদের ব্যবসায়ী ... যে ইসলাম জাত-পাত না মেনে জামাতে একই কাতারে নামাজ পড়ার শিক্ষা দিয়েছে- আজ একজন আব্দুল মোতালেবকে সবার আগে এসেও একেবারে প্রথম সারি থেকে উঠে গিয়ে সর্বশেষ কাতারে গিয়ে নামাজ আদায় করতে হচ্ছে! তবে এই নিয়ম ইসলামের বিধাঙ্গুলো থেকে আসে নাই। কিছু মানুষের নিজেদের মঙ্গড়া অলিখিত নিয়ম। একে আসলে নিয়ম বলাটাও ভুল হবে।

তবে এরা এই দুনিয়ায়ই প্রথম সারিতে থেকে যাবে। কিছু দিনের জন্য অবশ্য।

কিন্তু আরো একটা দিন আসছে... সেদিন আব্দুল মোতালেব নিশ্চয়ই প্রথম সারিতেই থাকবে।

একটা আশা ক্রমান্বয়ে ঘুরপাক খেতে থাকে একটি ক্লান্ত -ঘর্মাক্ত শরীরের স্বচ্ছ হৃদয়ে।।

Rose

বিষয়: সাহিত্য

৯৪৯ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

259550
৩০ আগস্ট ২০১৪ সকাল ০৮:১৫
কাহাফ লিখেছেন : মৌলিকতা ছুড়ে ফেলে অনুষ্ঠান সর্বস্ব এক ধর্মে পরিণত করেছে ইসলাম কে,কিছু মানুষ এরা-নিজেদের কায়েমী স্বার্থেই। অবসান হোক ঘুণে ধরা এমন মানষিকতার....।جزأكمالله خيرا..... মামুন ভাই Rose Rose
৩০ আগস্ট ২০১৪ দুপুর ১২:৫১
203414
মামুন লিখেছেন : অনুষ্ঠান সর্বস্ব ধর্ম থেকে আমাদের আসল-শান্তির ধর্মে ফিরে আসুক আবার। কায়েমী গোষ্ঠী হয় হেদায়েত পাক, না হয় সমগ্রের সার্থে নিপাত যাক। আপনার চাওয়াটা যেন আল্লাহপাক পুরণ করেন।

অনেক অনেক ধন্যবাদ ভাই।
জাজাকাল্লাহু খাইরান।Good Luck Good Luck
259559
৩০ আগস্ট ২০১৪ সকাল ০৮:৩৮
তহুরা লিখেছেন :
৩০ আগস্ট ২০১৪ দুপুর ১২:৫২
203415
মামুন লিখেছেন : আল্লাহ পাক আমাদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করুন, আমীন।
ধন্যবাদ আপনাকে মন্তব্যের জন্য।
শুভেচ্ছা রইলো।Happy Good Luck
259622
৩০ আগস্ট ২০১৪ দুপুর ০১:১৪
সুশীল লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ
৩০ আগস্ট ২০১৪ দুপুর ০১:২২
203422
মামুন লিখেছেন : আপনাকেও অনেক অনেক ধন্যবাদ এবং শুভেচ্ছা।Happy Good Luck
259634
৩০ আগস্ট ২০১৪ দুপুর ০২:১৫
মাহফুজ আহমেদ লিখেছেন : অসাধারন একটি লেখা শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ।
৩০ আগস্ট ২০১৪ দুপুর ০২:৪২
203431
মামুন লিখেছেন : ব্লগে সাথে থেকে গল্পটি পড়ার জন্যও আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ভাই।
শুভেচ্ছা রইলো।Good Luck Good Luck

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File